Students

  Teachers

  Staffs

 

ভ্যাকসিন গ্রহণের বিকল্প নেই





আজকের পত্রিকা
প্রিয় চট্টগ্রাম
সাক্ষাৎকার : ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ
উপাচার্য, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
দৈনিক সমকাল পত্রিকার হুবহু সাক্ষাৎকারটি নিম্নে তুলে ধরা হলো

টিকা মানুষের দেহকে নির্দিষ্ট কোনো একটি সংক্রমণ, ভাইরাস কিংবা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত করে। যে জীবাণুর কারণে রোগটি হয় টিকার মধ্যে তার একটি নিষ্ফ্ক্রিয় বা দুর্বল অংশ (ব্লু-প্রিন্ট) থাকে, যা দেহে জীবাণুর মতো একই রকমের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পরবর্তী সময়ে সেই জীবাণুর আক্রমণ শনাক্ত করতে এবং সেটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সহায়তা করে।

ইংরেজ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৬ সালে দেখেন, কাউপক্স বা গোবসন্ত রোগের মৃদু সংক্রমণ গুটিবসন্ত রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। তিনি তার এই তত্ত্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুই বছর পর গুটিবসন্তের টিকা আবিস্কার করেন এবং তখন থেকে লাতিন শব্দ 'ভ্যাক্কা' (যার অর্থ গরু) থেকে ভ্যাকসিন শব্দটির উৎপত্তি হয়। আধুনিক বিশ্বের চিকিৎসা দুনিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ধরা হয় ভ্যাকসিন বা টিকাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভ্যাকসিন বা টিকা সারাবিশ্বে প্রতিবছর অন্তত ২০-৩০ লাখ মৃত্যু প্রতিরোধ করে এবং ২০টিরও বেশি রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। টিকার কারণে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম, তবে অনেকের মধ্যে কিছু স্বাভাবিক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া যেমন- টিকা প্রয়োগের স্থানে ব্যথা বা হালকা জ্বর দেখা দিতে পারে। তবে এর পরের ধাপ হচ্ছে, টিকা গ্রহীতা ওই রোগটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা অর্জন করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসির মতে, ভ্যাকসিন বা টিকার সবচেয়ে শক্তিশালী বিষয় হচ্ছে, অন্য ওষুধগুলো যখন কোনো একটি রোগের প্রতিকার করে বা সারিয়ে তোলে, টিকা সেখানে ওই রোগের সংক্রমণকেই প্রতিরোধ করে। একই সঙ্গে অধিকাংশ জনগণের একই সময়ে টিকা গ্রহণের দ্বারা হার্ড ইমিউনিটি অর্জন সম্ভব এবং মহামারি মোকাবিলায় হার্ড ইমিউনিটির কোনো বিকল্প নেই।

করোনাভাইরাস যখন শরীরে প্রবেশ করে তখন এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শরীর একপর্যায়ে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি এবং সাইটোটক্সিক টি-সেল তৈরির মাধ্যমে ভাইরাস নিষ্ফ্ক্রিয় করে। কোনো দেহে ভাইরাস প্রবেশ করার আগে সুস্থ অবস্থায় ভাইরাসের একটি নিষ্ফ্ক্রিয় বা দুর্বল অংশ টিকার মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। তখন দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরবর্তী সময়ে করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে তার বিরুদ্ধে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, টিকার ফলে ওই একই ঘটনা ঘটে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করেই আসলে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরি করা হয়েছে। ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্না দুটি টিকাই মেসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিন, যা ভাইরাসের জেনেটিক কোড ব্যবহার করে। দুর্বল বা নিষ্ফ্ক্রিয় অ্যান্টিজেন ব্যবহারের পরিবর্তে এই টিকাগুলো দেহের কোষকে শেখায়, কীভাবে একটি 'স্পাইক প্রোটিন' তৈরি করতে হবে। এই স্পাইক প্রোটিনটি কভিড-১৯ ভাইরাসের উপরিভাগে থাকে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যে অ্যান্টিবডি দরকার হয়, সেটি তৈরি করতে সাহায্য করে এই প্রোটিন। টিকাকে মহামারি থেকে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে উলেল্গখ করা হয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা না থাকলে সবাইকেই কভিড টিকা নিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা কোভিশিল্ড বাংলাদেশে দেওয়া হচ্ছে। সেরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, যারা প্রতি মাসে পাঁচ কোটি ডোজের বেশি টিকা তৈরি করছে এবং এই কভিড টিকা উৎপাদনে তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। উল্লেখ্য, এই টিকা বেলজিয়ামে অবস্থিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার মূল ল্যাবরেটরিতে যে পদ্ধতি অনুসরণে তৈরি করা হচ্ছে, সেই একই গুণগত পদ্ধতি অনুসরণে সেরাম ইনস্টিটিউট এটি তৈরি করছে। কাজেই কোনো ভ্রান্ত ধারণা থাকা উচিত নয় যে, এ ভ্যাকসিন গুণগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এই ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা, নিরাপত্তা, রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা, ব্যাপকতা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার অন্যান্য ল্যাবরেটরিতে তৈরিকৃত ভ্যাকসিনের একই রূপ।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিডিসি বলছে, টিকা নেওয়ার কারণে কেউ কভিডে আক্রান্ত হবে না। কারণ এ পর্যন্ত যে টিকাগুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তাদের কোনোটিতেই জীবন্ত ভাইরাস নেই, যার থেকে কভিড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে ভ্যাকসিন বা টিকা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, সেগুলো মানুষের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে এবং সেটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম। যেহেতু কভিডের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে এবং দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে, তাই আক্রান্ত হোন আর না হোন, টিকা নেওয়া উচিত। তবে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা খুবই কম। কভিড আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রাকৃতিকভাবেই যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। আর একবার সেরে ওঠার পর ৯০ দিনের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণও আরও কম। তবে একবার কভিড আক্রান্ত হওয়ার পর টিকা নিতে ৯০ দিন অপেক্ষা করা উচিত। এ বিষয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে চায় সরকার। বৈশ্বিক মহামারি হওয়াতে ভ্যাকসিনের চাহিদা অনেক বেশি। এই প্রতিযোগিতায় ওপরের বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেশের জনগণের ভ্যাকসিন সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে। অনেক উন্নত দেশ এখনও ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে পারেনি। বিশ্বে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেওয়া দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য এর চেয়ে চমৎকার উপহার আর কী হতে পারে? সব ভ্রান্তি, সংশয় ও অনীহা ঝেড়ে ফেলে কভিড-১৯-এর টিকা গ্রহণের মাধ্যমে দেশ তথা গোটা বিশ্বের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা সফল হোক।